প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসির একশ' দিন
ব্যক্তিগত জীবনাচরণে বিনয়ী, কোমল ও দরবেশ স্বভাবের হয়েও প্রশাসনিক কর্মকান্ডে অতুল দৃঢ়তা, অসম সাহস, আর রাষ্ট্রনায়কসুলভ বিচক্ষণতার বৈশিষ্ট্যে অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ মুরসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মনোনয়নে ড. মুরসি ছিলেন ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির (ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা) বিকল্প প্রার্থী বা দ্বিতীয় পছন্দ। দু' দফায় অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবার আগে মিসরে তাঁর আহামরি খ্যাতি ছিল না। ব্রাদারহুডের প্রধানও তিনি নন। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি চমকপ্রদ ক্ষিপ্রতায় নিজের যোগ্যতা, দূরদর্শিতা ও অসাধারণ নেতৃত্বগুণের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মতত্ত্বে সমান পারদর্শী এই ইখওয়ান নেতা। যা প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্রভূমি নীলনদের তীরবর্তী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল দেশটিতে নতুন দিনের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। নির্বাচনী ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তিনি ৭ অক্টোবরের আগেই সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত পাঠিয়েছেন। যদিও তাঁর কর্মকান্ডে মিসর ও বাইরের কিছু বিশ্লেষকের অসন্তোষ, উদ্বেগ ও সতর্কবাণী উচ্চারিত হচ্ছে। অনেকের মতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর গণভিত্তি ও জনসম্পৃক্ততার বিষয়ে ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির কর্মসূচি ও মুরসির কর্মকৌশলে ভাবনার অনেক খোরাক মিলবে। প্রাসঙ্গিক কারণেই বিখ্যাত উর্দু ডাইজেস্ট পত্রিকা ড. মুরসীর ১০০ দিনের কার্যক্রম নিয়েই সেপ্টেম্বর ২০১২ সংখ্যার কভারস্টোরি করেছে। বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের জন্য এর সংক্ষিপ্ত সার উপস্থাপন করা হল।
গণমানুষের রাষ্ট্রপতি সাধারণ নাগরিকের অপার বিস্ময়:-
আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমার চিরচেনা মিসর এমনও হতে পারে! আমি তো স্বপ্নেও ভাবিনি যে, আমি মিসরের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারব। যিনি মিসরের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি তবে মিসরীয় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। আমার সামনে একজন সহজ-সরল, বিনয়ী আর বিনম্রভঙ্গিতে আলাপরত ব্যক্তিকে দেখে আমি দ্বিগুণ বিস্ময়ে থ বনে গেলাম। তখন আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না যখন দেখি মিসরের রাষ্ট্রপতির জামার আস্তিন ধরে একটি ছাত্রী বলছেন-‘আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন'! মিসরের প্রেসিডেন্ট বলছেন, আমি হাজির হয়েছি। তাঁর স্বর ছিল চাপা, অথচ তাঁর দুইপাশে তখন পূর্ণ ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলেন উর্দ্ধতন সামরিক কর্মকর্তাগণ। রাষ্ট্রপতি যখন আমার দিকে দৃষ্টি দিলেন, তখন আমি প্রায় অনুভূতিরহিত। তিনি জানতে চাইলেন, আপনার কি আর্থিক সহায়তা দরকার না ব্যক্তিগত ভাতা ? আপনার প্রয়োজন যাই হোক আমাকে নির্দ্বিধায় বলুন। আমি বললাম, আমার নিজের জন্য কিছু চাই না, আগুনে পুড়ে যাওয়া আমার ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাই- যে বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজী হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি রোগীকে দেখতে চাই। আমাকে তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিন। গাড়িতে শায়িত আমার ছেলেকে নিয়ে আসা হলে তিনি তার কপাল চুম্বন করলেন। তার জন্য পুনর্বার পানীয় আনালেন। অতঃপর হাসপাতাল পৌঁছানোর জন্য সরকারি গাড়ি আনতে নির্দেশ দিয়ে আমার সঙ্গে একজন সরকারি অফিসারও দিলেন। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, আমাদের মিসর এমনও হতে পারে! এ ঘটনার পর লোকটি দু'হাত তুলে হৃদয় উজাড় করে ড. মুহাম্মদ মুরসির জন্য দোয়া করলেন।
ঘটনাটি, বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকের ডা. মুহাম্মদ সামির তাঁর ফেইসবুকে বর্ণনা করেন। লোকটির যুবক ছেলের শরীরের ৪০% এরও বেশি জ্বলে গিয়েছিল। ডা. সামির বলেন, রোগীর অবস্থা দেখে আমি তাকে ভালো চিকিৎসার জন্য বড় কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলাম যেখানে তার প্রয়োজনীয় সুবিধাদি মিলবে এবং পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি সুলভ। আমি ভর্তি করতে অপারগতা প্রকাশের কারণে তারা হাসপাতাল প্রধানের কাছে ছুটে যায়। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালে সেখানেও আমি রোগীর অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে একই কথা বলেছি। হাসপাতাল থেকে চলে যেতে যেতে রোগীর আত্মীয়-স্বজন ধমকের সুরে বলছিলো কেবল স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় নয়; মিসর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তারা আমার ব্যাপারে অভিযোগ দেবেন। তাদের কথা শুনে আমি স্মিত হাসছিলাম কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই আমার হাসি হারিয়ে গেল। চোখের সামনে দেখলাম রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে পাঠানো একটি গাড়ি বারান্দায় দাঁড়ানো। গাড়ি থেকে নেমে আসা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা আগুনে পোড়া সেই রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি এবং সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় নির্দেশ শোনালেন। এখন আমার পক্ষে তাকে ভর্তি না করিয়ে কোনো গত্যন্তর থাকল না।
ডা. সামির লিখছেন, পুরোদমে গুরুত্বের সঙ্গেই রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে। এরই ফাঁকে একদিন আমাকে পুড়ে যাওয়া এই যুবকের পিতা মিসরের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার সাক্ষাতের ইতিবৃত্ত শোনালেন। এবং পরে এটাও বলতে ভুললেন না যে, ‘আমার ছেলের যথাযথ চিকিৎসায় কোনো গাফলতি হলে আমিই প্রথম তাহরীর স্কোয়ারে প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেমে পড়ব'। তিনি সেই ড. মুরসী যার সহধর্মিনী মিডিয়াকে সাফ জানিয়ে দিলেন, অনুগ্রহ করে তাঁকে যেন ফাস্টলেডি না বলা হয়।
ড. মুরসি রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি কীভাবে সামলাচ্ছেন এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর দৃষ্টিতে সেদিকেই নিবদ্ধ। হোসনি মুবারকের ৩০ বছরের দীর্ঘ শাসন অবসানের পর তিনি রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচিত হওয়া ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠান সহজ ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত মুরসি যিনি এখনও নিজের বাড়িতে বসবাস করেন। বাড়ির কাছে পৌঁছে তিনি দেহরক্ষী বাহিনীর বেষ্টনী ভেদ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন যাতে নির্বিঘ্নে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন। মজার হল, এই অমায়িক, সাদাসিধে মানুষটি কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসক ক্ষেত্রে মোটেও সাদামাটা থাকেননি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পর তিনি উচ্চ আদালত অঙ্গনে শপথ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে যাবার পরিবর্তে সোজা ছুটে গেছেন কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। যেখানকার হাজার হাজার ছাত্র তাঁর পক্ষে শীসাঢালা প্রাচীর হয়ে বুকটান করে দাঁড়িয়েছিল। যাদেরকে ড. মুরসির হাত ও বাহু বলা যায়; যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক-এ অতন্দ্র প্রহরীর মতো নিরন্তর সজাগ-সক্রিয় থেকে তাহরীর চত্বরকে ঐতিহাসিক তাহরীর স্কোয়ার বা প্রকৃত স্বাধীনতার প্রান্তরে পরিণত করেছিল। গণজাগরণ ও জনবিপ্লবের মাধ্যমে যে পরিবর্তন এসেছে তা যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা তরুণ প্রজন্ম সে ব্যাপারে প্রতিটি পদে পদে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
অন্যদিকে আরেকটি কৌতুহলের ব্যাপার হল, ব্যুারোক্রেসি ও সরকারি বহু কর্মকর্তা দীর্ঘদিন যাবত হোসনি মোবারকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও বিশ্বস্তার সম্পর্ক রয়েছে- তারা এখনও মুরসির চলার পথে কাঁটা বিছানোর তৎপরতা থেকে পিছু হটার নাম নিচ্ছে না। তাঁর নানা কর্মকান্ডের সমালোচনা ও বিভিন্ন পদক্ষেপের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তির ছড়ানোর চেষ্টায় লেগেই আছে। অথচ ওরা জানে, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাসড়ক দিয়ে রাষ্ট্রপতি যাওয়ার সময় পথচারী, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে কোনো প্রকার দুর্ভোগের শিকার হতে হয় না। লোডশেডিং হলে রাষ্ট্রপতির বাসভবনও তা থেকে বাদ পড়ে না। ড. মুহাম্মদ মুরসি শপথ গ্রহণের পর প্রথম দিন যখন আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন নিরাপত্তা বাহিনী মসজিদে দরোজায় একটি বৈদ্যুচিত দরোজা বসিয়েছিল যাতে প্রবেশকারী প্রত্যেক মুসল্লির স্বয়ংক্রিয় তল্লাশি হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি মুরসি এই পদক্ষেপের খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তা বাতিল করে দেন। জামিউল আযহারের খতিব রাষ্ট্রপ্রধানকে সামনে পেয়ে ইসলামের আলোকিত ঐতিহ্য অনুসারে ‘ইসলাম হল কল্যাণ কামনা' হাদিসের লক্ষ্যবস্তু মোতাবেক আমিরুল মু'মিন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর কর্মনীতি ও সেবামূলক সুশাসন এর বিবরণ এবং এর আলোকে ড. মুহাম্মদ মুরসির কাছে জাতির প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে এমন জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন যে, মুরসী অঝোরধারায় কাঁদলেন। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব এবং জাতীয় প্রত্যাশার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তিনি জানেন, যুদ্ধের ময়দানে উড়ন্ত প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে জাতির কী প্রত্যাশা জড়িয়ে থাকে।
প্রেসিডেন্ট মুরসির প্রথম ভাষণঃ-
নির্বাচনে এক কোটি বত্রিশ লাখ একশ' একুশ ভোট প্রাপ্তির খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাহরীর স্কোয়ারে সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। যা বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তার সেই ভাষণ ছিল, মৌলিক, সুচিন্তিত, সুগভীর প্রজ্ঞাসঞ্জাত। এত বড় বিজয়ের পর মানুষ যখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে। উচ্চাভিলাষী, আবেগের আতিশয্যে নিজের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পর্যন্ত ভুলে গিয়ে নেতৃত্বের রঙিন স্বপ্নে ডুবে যায়- মুরসি তখন হাজির হয়েছিলেন ভিন্ন অবয়বে। তিনি বলেছিলেন : ‘আমি কোনো দলের নই মিসরীয়দের প্রেসিডেন্ট। জাস্টিস এন্ড ফ্রিডম পার্টির পদ ও কেন্দ্রীয় দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিলাম। এ মিসর সকল মিসরীয় অধিবাসীর। অধিকারের প্রশ্নে সকলে সমান। আমার কোনো অধিকার নেই, আছে কেবল দায়িত্ব। মিসরের খৃস্টান, মুসলমান, সব মিসরীয়কে জাতীয় সংস্কৃতি ও উন্নয়নের অংশীদার হতে হবে। নাগরিক মর্যাদা, স্বাধীনতা, মানবাধিকারের সম্মান, নারী ও শিশুদের জন্য সকলকে কাজ করতে হবে। (নির্বাচনের সময় মিসরীয় কপটিক খৃস্টানেরা মুরসির সমর্থনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। নির্বাচনের প্রাক্কালে মিডিয়া একটি বানোয়াট বক্তব্য প্রচার করে তাদেরকে মুরসির বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালায়। বক্তব্যটি ছিল- ‘মিসরীয় খৃস্টান জেনে রাখা উচিত, বিজয় সন্নিকটে। আগামী দিনের মিসর হবে ইসলামের।') মিসরের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুরসিকে সংখ্যালঘু-বৈরী ও চরমপন্থী প্রমাণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এমনকি একটি টিভি চ্যানেল তাদের তিন ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রায় পুরোটাই ইখওয়ানুল মুসলিমীন ও মুরসির আচ্ছামতো খবর দিয়েছে! একটি কাল্পনিক ভিডিও চিত্র তৈরি করে দেখানো হয়েছে একজন খৃস্টান মেয়েকে চাবুক দিয়ে প্রহার ও অপমান করা হচ্ছে। ভিডিওটি প্রদর্শনের পর প্রশ্ন করা হলো- ওরা ক্ষমতায় গেলে কেমন শাসন প্রতিষ্ঠা করবে ? উত্তর দেয়া হলো- মদ্যপান ও বিকিকিনি নিষিদ্ধ করবে, ফলে মিসরের সৈকতকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। নারী, শিশু ও খৃস্টানদের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।...আমরা সারা বিশ্বকে শান্তির বার্তা শোনাতে চাই। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মিসরের সম্পাদিত সকল চুক্তি ও অঙ্গীকার আমরা রক্ষা করব। বাইরের কোনো রাষ্ট্রকে আমরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ দেবো না। আমরাও কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করব না। যদি আল্লাহর রহমত বর্ষিত না হতো, আমাদের সম্মানিত শহীদ ও আহত ভাইয়েরা বুকের তাজা রক্ত না ঢেলে দিতেন তবে আমি মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমপনাদের সম্মুখে প্রথম ভাষণ দেয়ার সুযোগ পেতাম না। সকল শহীদের উদ্দেশে বিনম্র সালাম জানাচ্ছি। তাদের উত্তরাধিকারী ও পরিবার-পরিজনকেও সালাম জানাই। তাদের প্রিয়জনেরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। যেসব মহান লক্ষ্য সামনে রেখে বিপ্লব হয়েছে তা অর্জনে আমাদের যাত্রা অব্যাহত থাকবে...।
‘আমরা ফেরাউনের উত্তরসূরি!'
বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে পরিচিত মিসরের সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশে মুরসির ভাষণটি ছিল খুবই হিসেবি, ভারসাম্যপূর্ণ, সুসম্পাদিত এবং সুবিন্যস্ত। জায়গাটি খুবই সংবেদনশীল, যেখানে উন্নত বিশ্বের প্রায় সব রাজনৈতিক নেতার পা পিছলে যায়। কয়েক দশক পর্যন্ত মিসরের সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সুবিধা ভোগ করে আসছে। মিসরের ইতিহাসে দীর্ঘসময়ের রাষ্ট্রপ্রধান আনোয়ার সাদাত তার পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন হোসনি মুবারকও ছিলেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমনকি হোসনি মুবারকের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিক যাকে জনগণের তীব্র ক্ষোভের মুখে মাত্র ৩৩ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে হয়েছে তিনি সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ডার এবং এয়ার মার্শাল পদে পর্যন্ত অভিষিক্ত হয়েছিলেন। ২০১১ সালের নভেম্বর-এ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি সেনাবাহিনীর-ই মুখপাত্র ছিলেন। তাই তিনি সামগ্রিক জনমতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবেই হোসনি মুবারক তিনি নিজের রোল মডেল দাবি করতেন। হোসনি মুবারকের উত্তরসূরি হওয়ায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাকে ঘৃণা করতেন- সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
শুধু সেনাবাহিনী নয়; বরং তাদের পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন সরকার পর্যন্ত তাকে সহায়তা করে যাচ্ছিল। আহমদ শফিককে উদার, আধুনিক সেক্যুলার গোষ্ঠীর মুখপাত্র এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম সারির ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন মহল থেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে সামনে আনা হয়েছিল। একদিকে যখন মিসরের কপটিক (কিবতী) খৃস্টানেরা কোমর বেঁধে নির্বাচনী কর্মকান্ডে নেমেছিল তেমন এক মোক্ষম পরিস্থিতিতে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীকে ৯ লাখ ভোটার আইডি কার্ড দিয়েছিল যাতে তারা আহমদ শফিকের বাক্স ভর্তি করে দিতে পারে। নির্বাচনী হাওয়া মুরসির দিকে মোড় নিতে দেখে ১৪ জুন সাংবিধানিক আদালতকে ব্যবহার করে আরেকটি ক্যু ঘটানো হলো। পার্লামেন্ট নির্বাচন বাতিল ও নির্বাচিত সংসদকে বিলুপ্ত করা হলো। যে নির্বাচনে ইখওয়ানুল মুসলিমীন সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। অভিযোগ ছিল নির্বাচনী আইন মোতাবেক ১৬৬টি আসনে দলীয় প্রার্থীরা নির্বাচন করতে পারবে না কিন্তু তা মানা হয়নি। অর্থাৎ অধিকাংশ প্রার্থী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ছিলেন।
সাংবিধানিক আদালত বলল, এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকার খর্ব হয়েছে। রায়টি এমন সময় দেয়া হলো, যখন জনগণের রায় একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্তমূলক সূচক নির্দেশ করছে। ঘটনার এখানেই শেষ নয়; ২০ সদস্য বিশিষ্ট সুপ্রিম কাউন্সিল ফর আর্মড ফোর্সেস বা সর্বোচ্চ সামরিক পরিষদ ১০০ সদস্যের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিও বাতিল করে দেয়। যাদের মধ্যে সংসদ সদস্য ছাড়াও ৬ জন বিচারপতি, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। সামরিক পরিষদ কেবল রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাই খর্ব করেনি বরং সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ফলে জনগণের কাছে সেনাবাহিনীর অভিপ্রায় সম্পর্কে পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে গেল। ...নানান টালবাহার পর অবস্থা বেগতিক দেখে জনগণের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন সামরিক কাউন্সিল ২৪ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। এতে ড. মুহাম্মদ মুরসিকে ১০ লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এটি কোনো মামুলি বিজয় ছিল না। মিসরের বাইরে অবস্থান করে কারো পক্ষে এই নির্বাচনের উত্তাপ আন্দাজ দূরে থাক কল্পনাও করা সম্ভব নয়। মুরসির বিরুদ্ধে স্লোগান ছিল- আমরা ফেরাউনের উত্তরসূরি। এমন স্লোগানদাতারা মিসরের প্রাচীন যুগের সম্রাট ফেরাউনের মতো- যারা মুসার প্রভুর হাতে লোহিত সাগরে ডুবে মরেছিল- জনরায়ের মহাসাগরে সমাহিত হয়েছে। যে মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনার মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুরসির নাম ঘোষণা করছিল, তখন লাখো নাগরিকের গগনবিদারী আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে তাহরীর স্কোয়ার প্রকম্পিত হচ্ছিল। এই ঘটনাপ্রবাহ গণমাধ্যমের বরাতে বিশ্বের মানুষ ইতোমধ্যেই বিস্তারিত অবগত হয়েছে। এই তাকবীর ধ্বনির তরঙ্গামালা তাহরীর স্কোয়ার থেকে ফিলিস্তিনের গাজা পর্যন্ত অাঁছড়ে পড়ছিল। ফেইসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিকট ও দূরপ্রাচ্যের বিশ্বাসী মানুষ পরস্পরকে অভিনন্দন বার্তা পাঠাচ্ছিল। প্রতিটি নামাজের সময় মিসরের লাখো মানুষ আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতায় সিজদায় লুটে পড়ছিল। মিসরজুড়ে এই আনন্দের খবর পৃথিবীর মানুষ কমবেশি জেনেছে।
মুরসি মিটার
তাহরীর স্কোয়ার ও সোস্যাল নেটওয়ার্ক এর স্বেচ্ছাসেবীগণ নিজেদের মতো করে মুহাম্মদ মুরসির ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে তাঁর সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব রাখতে একশ' দিনের একটি টাইম লাইন বেঁধে দেয়। এভাবে প্রতিটি দিন ও প্রতিটি প্রহরকে গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে। ইন্টারনেটে তারা একটি ‘মুরসি মিটার' খুলেছেন। রাষ্ট্রপতি মুরসির কর্মকান্ডের ব্যাপারে যা কাঁটা মেপে চলেছে। ৬০ বছরের বস্তাপচা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পুঁতিগন্ধময় উত্তরাধিকার এ দাঁড়িয়ে জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন ও জাতির জন্য সুদিন ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত চাট্টিখানি কথা নয়। এদিকে মুরসির জন্য মিটার কিন্তু বসে থাকেনি। সে খুব দ্রুত তার পথ পরিভ্রমণ করে চলেছে। নয়তো তুর্কি মডেলকে তিনি বেশ কাজে লাগাতে পারেন। মুরসি বড় শক্তি যুবসমাজ, তারা তাঁর সিদ্ধান্তের একই সঙ্গে কঠোর সমালোচক ও উচ্ছ্বসিত স্তাবক বিবেচিত হচ্ছে। প্রতিপক্ষের কাছেও তরুণ প্রজন্মই শক্তির ফ্রন্ট লাইন। এ মুহূর্তে তাঁকে একই সঙ্গে কয়টি ফ্রন্টে লড়তে হচ্ছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
আইএমএফ'র ঋণ সহায়তা ও স্বামীর বদলে বিদ্যুৎ
অন্যদিকে মিসরের ভঙ্গুর আর্থিক কাঠামোকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো সহজসাধ্য নয়। দিনে আট ঘণ্টা পর্যন্ত এখানে বিদ্যুৎ থাকে না। মিসরের আদালতে একটি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক মামলা চলছে। লোডশেডিং এর যন্ত্রণায় অতীষ্ঠ এক মহিলা স্বামীকে কায়রো যেতে সম্মত করতে না পারায় তালাকের জন্য আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। তার বক্তব্য হলো, এই লোকের সঙ্গে থাকার চেয়ে আমি বরং বিদ্যুতের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে চাই। মিসরের অর্থনীতি পুনর্গঠনে ৪৮০ কোটি ডলারের আইএমএফ'র এখনও স্রেফ অনুমোদন ও প্রতিশ্রুতির চৌকাঠ পেরিয়ে সরকারি কোষাগার পর্যন্ত আসতে পারেনি। আপাত এই প্রতিশ্রুতিতে জনগণের বিশেষ কোনো প্রাপ্তি নেই। গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে সেই ঋণের ছাড় পাওয়া পর্যন্ত যে কোনোভাবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখাটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুরসি ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিরবৈরী এই ইখওয়ান নেতার আমেরিকা সফর নানা কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ সফরে জাতিসংঘেও মুরসি ভাষণ দেয়ার কর্মসূচি ছিল। হোসনি মুবারক আমলে কংগ্রেসের ঘোষিত তিন বিলিয়ন ডলারের সহায়তা এখনো পাওয়া যায়নি। নির্বাচিত হবার পর প্রথম বিদেশ সফরে মুরসি সৌদি আরব আগমনের সময় দেশটির সরকার ৪.৮ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ঘোষণা করে এবং তা সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়েও দেয়া হয়েছে। এমন মুহূর্তে দেশের উন্নয়ন তো দূরের কথা; বিপ্লবের ঘোষণা প্রচারের ক্ষেত্রে পর্যন্ত যখন ফান্ডের অভাব দেখা দেয়- তখন-ই কেবল একজন নেতার মহাপরীক্ষা উপস্থিত হয়। মুরসি তরুণদের জাতির সেবা ও সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন। যাতে ইখওয়ানের সমাজসেবামূলক কর্মসূচির আমেজ ব্যাপকভাবে ধরে রাখা যায়। দিন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। ইখওয়ানের হাসপাতাল, কৃষি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বেশ তৎপরতার সঙ্গে তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের নিঃস্বার্থ ও নিষ্ঠাপূর্ণ জীবনধারার আকৃষ্ঠ হয়েই মিসরের জনগণ দিন দিন তাদের প্রতি জোরালো সমর্থন জানাচ্ছে।
মিসরের আদালত : অতীত অক্টোপাসের শক্তিধর বাহু
অতীতের অক্টোপাসতুল্য একনায়কতন্ত্রের শক্তিশালী দু'টি বাহুর একটি সামরিকবাহিনী অপরটি হলো আদালত। অতীতের স্বৈরাশাসকের মিত্র হিসেবে সেই দুঃশাসন ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সম্ভব সবচেষ্টা তারা চালিয়েছে এবং সেই পরিকল্পনা থেকে তারা এখনও সরে আসার মতো স্পষ্ট আলামত প্রত্যক্ষ করা যায়নি। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য সাতখুন মাফের সার্টিফিকেট দিতো এই আদালত এর সুবিধাভোগী বিচারকগণ।
মিসরীয় সুনামি : কাঁটা ও প্রত্যাশার মুকুট
নিজের রাজনৈতিক উত্থানপর্বের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতে না রাখতেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধাপড়া মুহাম্মদ মুরসি দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ৫০ দিনে অত্যন্ত চমকপ্রদ ক্ষিপ্রতায় যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন মিসর সুনামির এসব ঝড়ো সিদ্ধান্তে পৃথিবী বাস্তব অর্থেই হতবাক হয়ে গেছে। পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী ও প্রচন্ড আত্মপ্রত্যয়ী ড. মুহাম্মদ মুরসি নিজের ৫০ দিনের পথপরিক্রমায় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন ধারাবাহিক সুসম্পর্ক ও নিরন্তর সাধনা নয় অন্তরের উদারতা, দৃষ্টির প্রসারতা ও চিন্তার গভীরতাই রাজনীতির ময়দানে সফলতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিতে পারে। বর্তমান মিসর পার্লামেন্টশূন্য অবস্থায় রয়েছে। সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া চলমান। তরুণ প্রজন্ম এই সময়ের ইতিবাচক উত্তরণের অস্থির অপেক্ষায় পার করছে প্রতিটি মুহূর্ত ও পথ। এমন পরিবর্তন যা তাদের জীবনেও পরিবর্তনের হাওয়া বইয়ে দেবে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাহরীর স্কোয়ারে বিক্ষোভ-সংগ্রাম ও অবস্থান করে বহু সংখ্যক সঙ্গী-সহযোদ্ধার জীবনের বিনিময়ে তারা এই বিপ্লব এনেছে। মুরসির মাথায় একই সঙ্গে তাদের পরিয়ে দেয়া প্রত্যাশার পু আর সঙ্কটের কাঁটায় সাজানো এক মুকুট শোভা পাচ্ছে। দেশটির সচেতন অংশের অনেকেই তাঁর পায়ের নিচ থেকে ক্ষমতার মইটি সরিয়ে নিতে সদা তৎপর।
কালো রাতের অবসান
৩ জুন ২০১২। এক বিচারে দিনটি বেশ তাৎপর্যমন্ডিত ও ঐতিহাসিক। এই দিন ৭৬ বছর বয়স্ক ফিল্ড মার্শাল তানতাভীসহ সশস্ত্রবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রথমবারের মতো মিসরের কোনো সিভিলিয়ান (অসামরিক ব্যক্তি)কে স্যালুট করলেন। এই সম্মানটি মুরসির ভাগ্যে এসেছে। ক্ষমতারোহণের প্রথম দিন থেকে মুহাম্মদ মুরসি সাংবিধানিক আদালত ও সেনাবাহিনীর তৈরি করা ছকের ওপর চলার কথা। ক্ষমতা ও এখতিয়ারের ভিত্তিভূমি হয়ে উঠেছিল সেনা কাউন্সিল। তারা কেবল ড. মুরসির দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার কারণেই নির্বাচিত পার্লামেন্ট এর কার্যকারিতা বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব করে তাঁকে স্রেফ সাক্ষী-গোপালে পরিণত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের সমুদয় ক্ষমতার ডানা ছেঁটে মুরসিকে কাগুজে রাষ্ট্রপতি করে রাখতে চেয়েছিল সামরিক কাউন্সিল ও সাংবিধানিক আদালত। একটি গণবিপ্লবের মাধ্যমে সূচিত পরিবর্তনের পথ ধরে অনুষ্ঠিত গণিতান্ত্রিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ড. মুহাম্মদ মুরসি এরকম ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে থাকতে সম্মত রয়েছেন কিনা সে প্রশ্নটি দেশের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
বাঘের পিঠে সওয়ারী মুরসি!
নিজের অতীত পটভূমি এবং স্বকীয় ব্যক্তিত্বের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কোনো দিক থেকে মুরসিকে পেছনে ফেলে রাখার সুযোগ নেই। এরূপ টলায়মান পরিস্থিতিতে তিনি শুধু বাস্তব পরিবর্তনের স্বাক্ষর-ই রাখেননি বরং নিজেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রকের আসনে তুলে এনেছেন। এভাবেই তিনি অপ্রত্যাশিত কালোরাতের মতো সামরিক আধিপত্য ভেদ করলেন আর দায়িত্ব গ্রহণের পরই পার্লামেন্ট বহাল করার ঘোষণা দিয়ে মিসরজুড়ে অনেকটা হৈ চৈ ফেলে দেন। সেনাবাহিনী ও সাংবিধানিক আদালতের বিরোধিতা উপেক্ষা করে ড. মুরসি পার্লামেন্টের সংক্ষিপ্ত অধিবেশন ডেকে রাষ্ট্রপতির জারিকরা এক ফরমানে সামরিক কাউন্সিলের বাতিল করা ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি সারা দুনিয়ার বিশ্লেষক, লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের যারপরনাই অবাক করে দিয়ে একটি পদক্ষেপ নেন। এ ঘোষণা প্রচারিত হবার পর গোটা মিসরে আনন্দের বন্যা বইয়ে যায়। সর্বস্তরের মিসরবাসী রাজপথে উল্লাসে মেতে উঠে। হোসনি মোবারকের পতনের পর সামরিক বাহিনী যেভাবে ক্ষমতার বাগডোর নিজেদের হাতে নিয়েছিলেন-তাতে কবে নাগাদ তা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ফিরে আসবে সে বিষয়ে জনমনে ঘোরতর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। সময়োচিত এক ঝাঁকুনিতেই তিনি সেই অচলায়তন ভেঙে দিয়ে গণতন্ত্রকে অর্গলমুক্ত করলেন।
রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র ইয়াসির আলীর পক্ষ থেকে জারিকরা ফরমানে বলা হয়েছে : জেনারেল আবদুল ফাত্তাহকে নতুন সামরিক মুখপাত্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সামরিক কাউন্সিলের মধ্যে তিনি অপেক্ষাকৃত কম বয়সী জেনারেল। তাঁর বয়স মাত্র ৫৭ বছর। এই প্রেক্ষাপটে তিনি প্রশংসা করে বলেন, ‘এখন থেকে সামরিকবাহিনী জাতীয় প্রতিরক্ষার কাজে পুরো মনোনিবেশ করতে পারবে।' একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাখর্বকারী আইনি আদেশটিও বাতিল করে দেন। গোটা পৃথিবী হতবাক হয়ে যায়, ফিল্ড মার্শাল তানতাভী, সামরিক বাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল সামী ইনান ছাড়াও বিমান ও নৌ বাহিনী প্রধান, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের প্রধান কমান্ডার, গোয়েন্দাপ্রধানের মতো ব্যক্তিকে অপসারণের ঘটনাকে সেনাবাহিনী নিজেদের জন্য পুরোপুরি স্বাভাবিক, ইতিবাচক ও নতুন নেতৃত্বের ভাগ্য পরিবর্তন-প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়েছে। সিএনএন ও বেশ ক'জন শীর্ষ বিশ্লেষকের মন্তব্য ছিল- মুরসি বাঘের পিটে চড়ে বসলেন। এখন যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। চারিদিকে বিশ্লেষণ ও মন্তব্যের সয়লাব বইয়ে যাচ্ছিল।
কারো মতে, সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কেউ বলছেন- এই সিদ্ধান্ত সামরিক বাহিনী কীভাবে মেনে নেবে? কোনো বিশ্লেষক বললেন, এটি বড় ধরনের জুয়ার চাল। এমন অনেকে এটাকে মুরসির পাগলামী আখ্যায়িত করলেন। কারণ তানতাভী কুড়ি বছর অবধি মিসরের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে আছেন। তবে বিশ্লেষকরা যে বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলেন তা হল- বিশ বছর ধরে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতিও থেমে ছিল। উপরের পদগুলো খালি না হলে নিচ থেকে পদোন্নতি কীভাবে হবে? ৭৬ বছর বয়সী তানতাভী অনেক আগেই সরকারি চাকরির বয়স পার করে এসেছেন। তাকে পদচ্যুত করার সাহস খোদ হোসনি মুবারকেরও ছিল না। ষাট বছর একজন অসামরিক প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনীতি ও নেতৃত্বের আসনে চেপেবসা সামরিক ব্যক্তির প্রতীকী কর্তৃত্ব উপড়ে ফেললেন। রাফা ক্রসিংয়ে নজীরবিহীন হামলার পর গোয়েন্দা ব্যর্থতার দায়ে সীমান্তবর্তী প্রদেশটির গভর্নরকে অপাসরণের পর স্থানীয় বেদুইন সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি তছনছ করে দেয়ার হুকুম দেন। কৌতুকপ্রদ ব্যাপার হল, সেনাবাহিনীর পাল্টা হামলায় বেঁচে যাওয়া সন্ত্রাসীদের ইসরাইলি সেনাবাহিনী লুকিয়ে রেখেছে মর্মে তথ্য চাউর হয়েছে। সেনাবাহিনীর এ ক্রেকডাউনে বহু বিদ্রোহী প্রাণ হারায়। মুরসির দৃঢ় সিদ্ধান্তের ফলে সীমান্ত বিদ্রোহীদের বহুদিনের শক্ত ঘাঁটি গুড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়।
মুরসির ফুঁকে কাজ হয়!
উর্ধ্বতন সেনা অফিসারদের অপসারণের পর বিবিসিসহ বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন- ‘জেনারেলদের চেরাগ ফুঁৎকারে নিভানো যাবে না।' ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে যাবার পরও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া না আসায় তারাই আবার বলতে বাধ্য হলেন- ‘মুরসি ফুৎকার কাজ দিয়েছে'।
যতটুকু মনে হয় ততোটা সরল নয়!
তিনি সেই মুরসি যিনি শপথ গ্রহণের প্রথম দিনই বলে দিয়েছিলেন- এখন থেকে সামরিক বাহিনী নিজেদের আসল দায়িত্ব অর্থাৎ জনগণ ও তাদের সীমানার প্রহরার কাজে আঞ্জাম দেবে। তখন সেটা স্রেফ রাজনৈতিক ও নতুন রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে একটি নির্দোষ বক্তব্য মনে করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেছিলেন যে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল। দেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরি বিষয়টিও নির্ভর করছে এই পার্লামেন্টের ওপর। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক খ্যাতিমান বিশ্লেষক মুগদী আবদুল বাদী এ প্রসঙ্গে বলেন, মুরসিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে খুবই জটিল এক সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে।' তিনি বলেন, এখনও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বহু পদে হোসনি মুবারকের বাছাই করা ও অনুগত লোকেরা বহাল তবিয়তে বসে আছেন। তারা মুরসির ইচ্ছামাফিক কাজ করবেন না। তবে তাঁর বিশ্লেষণের ওপর বেশ ক'টি মোটা দাগের প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখাপাত করে। প্রথমত, মুরসি বিগত অস্থায়ী সামরিক সরকারের এক মন্ত্রী হিশাম কান্দিলকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। মজার ব্যাপার হল, ইখওয়ান কিংবা নির্বাচনে বিজয়ী ড. মুরসির ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি কারও সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না। তিনি একজন প্রকৌশলী ও টেকনোক্রেট হিসেবে অধিকতর পরিচিত। তাঁকে নিয়োগের সময় রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন- দীর্ঘ পরামর্শের পর একজন দেশপ্রেমিক ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে এ পদে আসীন করা হল।
রাষ্ট্রপতির সমালোচনা রোধে নিবর্তনমূলক আইন বাতিল
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক মুখপাত্র বলেন, মিসরের নতুন প্রেসিডেন্ট সেসব সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন, যারা বলে আসছিলেন রাষ্ট্রপতি তাঁর বিরুদ্ধে মিডিয়ার কোনো সমালোচনা সহ্য করবেন না। সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধে প্রণীত যে আইনটি বিগত ৩০ বছর ধরে বাতিলের প্রস্তাব উত্থাপিত কিংবা প্রত্যাশা উদিত হয়নি মুরসির ক্ষমতা গ্রহণের ৫০ দিনের মাথায় বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা বাতিল করে দেন। অথচ মুরসির প্রতিপক্ষ ও সমালোচকরাই এর বেশি সুফল ভোগ করবেন।
বিখ্যাত টিভি ভাষ্যকার চার্লস সিনেট একটি চমৎকার ও বিস্ময়কর বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেন, ইখওয়ানুল মুসলিমুন একটি রাজনৈতিক দল নয়; তারা একটি সামাজিক আন্দোলনের ধাঁচে কাজ করে যায়। তাদের উদারতা দেখুন, তারা বিপ্লব সফল করা ও ক্ষমতা নিজেদের হাতে পাবার কৃতিত্ব দাবি করে না। কিন্তু যে পর্যন্ত তাহরীর স্কোয়ারে ইখওয়ান কর্মীরা জড়ো হয়নি ততদিন তা দৃষ্টিগ্রাহ্য জনসমাবেশের রূপ ধারণ করেনি। তারা এসেই আহতদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন ও অবস্থানকারীদের জন্য খাবারের আয়োজন করে। সবচেয়ে বড় কথা হল, তাহরীর স্কোয়ারে হোসনি মুবারক সমর্থকদের ঝটিকা হামলা ও বার বার বিশৃংখলা তারা রুখে দিয়েছে; ইখওয়ান শুধু প্রতিরোধবেস্টনী নয় রীতিমতো নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে দেয়।
এখন ইখওয়ানের বক্তব্য হল, আমরা মিসরে ভালো মুসলমান হিসেবে জীবনযাপনের জন্য পরিবর্তন আনতে চাই। আমরা ইসলামি শরীয়তকে আইনের উৎস বানাতে চাই যাতে মুসলমানদের ইসলামি জীবনযাপন সহজ ও স্বচ্ছন্দ জীবন পরিচালনার সহায়ক হয়। বিরোধীদের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থানের কৌশল ব্রাদারহুড রপ্ত করে নিয়েছে। তাই কট্টরপন্থী সালাফী ও কপটিক খৃস্টানদের সাথে পথ চলতে তাদের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মুসলিম দেশসমূহের ইসলামি সংগঠনগুলোর ভাবার বিষয় হল- ব্রাদারহুডের সদস্য ছয় লাখ কিন্তু তাদের ভোটার ১ কোটি ৩৩ লাখ।
প্রতিশোধ নয়; বন্ধুত্ব!
প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসি কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গেলে অফিসাররা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। তিনজন অফিসার দু'জনের মধ্যবর্তী ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট মুরসির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বললেন, ইনি ব্রিগেডিয়ার ইবরাহিম শারবিনী। মুরসি মুচকি হেঁসে বললেন, হ্যাঁ তাকে তো আমি আগে থেকেই চিনি; তিনিই তো আমাকে রাত ২টায় বাসা থেকে গ্রেফতার করতে গিয়েছিলেন। ...এবং তার সঙ্গে পাশের আপনারা দু'জন ছিলেন সেদিন। একথা শুনে উপস্থিত সকলেই একযোগে হেসে উঠেন। তাদের বুঝতে বাকি ছিল না যেকোনো দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণ ক্ষমা করে দেবার মতো বড় মন যার আছে তাঁর মুখ থেকেই এরূপ মন্তব্য আশা করা যায়।
উর্দু ডাইজেস্ট (সেপ্টেম্বর ২০১২ অবলম্বনে)