ইসলামী সৈনিক ইবনে বতুতা এবং তার সময়ঃ
সমসাময়িক রাজনীতির বিপরীতে দৃশ্যমান প্রান্তিক লোকরঞ্জক ধারণায় পরিপুষ্ট হয়ে মধ্যযুগের সমাজকে প্রায়ই কল্পনা করা হয় বিশ্ব-পরিচিত, বিজয়ী, অনুসন্ধানী, বণিক-অভিযাত্রী, ধর্মীয় প্রধান এবং রাজা হওয়া উচ্চাভিলাষী ও প্রতিভাধর নর-নারীর অধ্যুষিত যুগ হিসেবে। ওই সময় এ ধরনের লোক অবশ্যই ছিল। তবে তাদের সংখ্যা ছিল বিরল। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এ ধরনের লোক খুবই বিরল। প্রমাণের বিপরীতে মধ্যযুগীয় সমাজকে আবদ্ধ ও ধর্মকেন্দ্রিক হিসেবেও দেখা হয়। ওই সমাজকে ব্যাখ্যা করা হয় তখনকার ঘটনাকে আমলে না নিয়েই। লোকজন ও আইডিয়ার গতিশীলতা এবং বিনিময় ওই কালটি বিবেচনায় না নিয়েই ব্যাখ্যা করা হয়। ফলে যেসব পর্যটক তাদের ভাষ্য রেখে গেছেন, তাদের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইবনে বতুতার ব্যক্তিত্ব এবং কিংবদন্তি এ ব্যাপারে খুবই সহায়ক। তার কাহিনী এমনকি তার সমসাময়িক মার্কো পোলোর তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত। তার ভাষ্য হারানো পৃথিবীকে দেখার সুযোগ এনে দেয়। রক্ষণশীল মুসলিম বিচারকের দায়িত্ব পালন করেও তিনি জ্ঞানের প্রতি ছিলেন লালায়িত। নতুনকে জানার আগ্রহ তার মধ্যে এতটাই ছিল যে কখনো একই পথ দু’বার ব্যবহার করেননি। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুসন্ধানের অনন্য একটি জীবন তিনি কাটিয়েছেন। বিপদ আর অভিযাত্রার অদম্য আকাক্সক্ষা ছিল তার মনে। এই আকাংক্ষা চরিতার্থ করতে গিয়ে তিনি এমন এক সমাজের রহস্য উন্মোচন করেছেন, যা ছিল টলমলে, নানামুখী সঙ্ঘাতে ভরপুর। বর্তমান সময়ে আইন ও সংবাদপত্র রক্ষণশীলতার জন্য মুসলিমদের তীব্র সমালোচনা করা হয়। কিন্তু তার ভ্রমণকাহিনী ইসলামি বিশ্ব হিসেবে বিবেচিত দুনিয়ায় নানা প্রথা, নানা বৈশিষ্ট্য উপহার দেয়। তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই ভ্রমণকথা তুলে দিয়েছেন বলে মনে হয়।
উৎসঃ
বতুতা ছিলেন বারবার সুন্নি মুসলিম পরিবারের সন্তান। মরক্কোর তানজিয়ার্সে তার পরিবারের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য সুনামের অধিকারী ছিল। ১৩২৫ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য হজ করতে মক্কায় যান। এই শুরু। তারপরের ২৯টি বছর কাটে সফরে সফরে। তিনি ওই সময়েল দারুল ইসলামের বেশি ভাগ স্থান সফর করেছেন। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ভূমধ্য সাগর, মধ্য ও দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, চীন- সবমিলিয়ে আধুনিক দুনিয়ার প্রায় ৪৪টি দেশ তিনি সফর করেছেন। পাড়ি দিয়েছেন প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার পথ। ইবনে বতুতার বিস্ময়কর সফর তাকে হিমশীতল পার্বত্য পথ, দুর্গম মরুভূমি, উত্তাল নদী, ঘন অরন্য, জনশূন্য প্রান্তরে নিয়ে গেছে। কখনো রাজা-বাদশাহরা তাকে স্বাগত জানিয়েছেন, কখনো তিনি সাধারণ মানুষের মতো দিন কাটিয়েছেন। ডাকাত, জলদস্যূ, বুনো প্রাণীর মুখে পড়েছেন। খ্যাতনামা মুসলিম পণ্ডিতদের কাছ থেকে সরাসরি জ্ঞান লাভের প্রবল ইচ্ছা যেমন তার ছিল, তেমনি নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ বানানোর অভিলাষও তার ছিল। বিয়ে করেছিলেন অনেকবার, সফরসঙ্গীও ছিল অনেক। সন্তানও ছিল কম নয়। তিনি তার সফরনামা তুলে ধরেছেন রিহলা কিতাবে। রিহলা মানেই ভ্রমণ। বতুতার ওপর সর্বোত্তম পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত টিম ম্যাকিনটোস-স্মিথ ‘রিহলা এন ইপিক ট্রাভেলগ অ্যান্ড’ নামে বিবিসির একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিলেন।
তিনি রিহলাকে অভিহিত করেছিলেন ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণা হিসেবে, তীর্থযাত্রার নির্দেশিকা আর শোনা কথার কলাম হিসেবে। আমেরিকান লেখক ডগলাস বুলিসের মতে, রিহলা নতুন একটি ধারার সৃষ্টি করেছিল। এরপর যারাই ভ্রমণসাহিত্য রচনা করেছিলেন, তারা সবাই রিহলাকে অনুসরণ করেছিলেন। তিনি সমাজ, রাজনীতি, ভূগোল, প্রথা, ব্যক্তিত্বকে ধর্মীয় স্থান ও শ্রদ্ধেয় লোকদের থেকে আলাদা করে তুলে ধরেছিলেন। অবশ্য তার বইতে কিছু অসামঞ্জস্যতাও দেখা যায়। এর মূল কারণ সম্ভবত এটি লেখা হয়েছিল তার সফর শেষ করার ৩০ বছর পর। ফলে অনেক কিছুই জট পাকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও কথ্য ইতিহাসের এক মহা সূত্র এই বইটি। তার ইংরেজি অনুবাদক এইচ এ আর গিবস একে ‘প্রথম ও সর্বপ্রথম মানব-ডায়েরি’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
দিল্লি এবং এর সুলতানঃ
অনেক জনপদ পাড়ি দিয়ে ইবনে বতুতা ১৩৩৪ সালে দিল্লির সুলতান মোহাম্মদ বিন তোগলকের দরবারে হাজির হয়েছিলেন। তিনি সাড়ে ৮ বছর ছিলেন দিল্লিতে। দিল্লি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন : পর দিন আমরা দিল্লিতে পৌঁছালাম। এটা ভারতের মেট্রোপলিস, বিশাল ও চমৎকার নগরী, শক্তি দিয়ে এর সৌন্দর্য অটুট রাখা হয়েছে। এর নগর-প্রাচীর এত বিশাল যে, যার কোনো তুলনা পৃথিবীতে নেই, পুরো মুসলিম প্রাচ্যে এটাই বৃহত্তম নগরী।
কুতুব মিনার সম্পর্কে তিনি বলেছিলেনঃ
উত্তর দিকে মিনারটি অবস্থিত। দারুল ইসলামে এ ধরনের আর একটি মিনারও নেই। লাল পাথরে তৈরি এটি। ভাষ্কর্য দিয়ে একে সাজানো হয়েছে। ঝকমকে শ্বেত মার্বেলের বলটি শীর্ষে স্থাপন করা হয়েছে। এর আপেলগুলো (মিনারের চারপাশের ছোট বল) খাঁটি সোনার। পথটি এতই চওড়া যে, এখান দিয়ে হাতির পালও চলাফেরা করতে পারে। আমার আস্থাভাজন এক লোক আমাকে বলেছেন, নির্মাণের সময় তিনি এর শীর্ষে একটি হাতিকেও চড়তে দেখেছেন।
আর মেহরুলির লৌহ স্তম্ভ সম্পর্কে তার বয়ানঃ
মসজিদের কেন্দ্রে ভয়-জাগানো একটি স্তম্ভ। কোন ধাতু দিয়ে একে তৈরি করা হয়েছে, তা কেউ জানে না। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে বলেছেন, একে বলা হয় ‘হফত জশ’, অর্থাৎ সপ্ত ধাতু। সাতটি ধাতু দিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই স্তম্ভের একটি অংশ, আঙুলের সমান চওড়া, পালিশ করা এবং দারুণ চমক দেখায়। লোহা এর সামনে কিছুই নয়। এটা ত্রিশ কিউবিট উঁচু। আমরা এর চারদিকে পাগড়ি পেঁচিয়েছি এবং যে অংশটি একে বৃত্তাবদ্ধ করেছে, তার উচ্চতা আট কিউবিট। ধন-সম্পদের কিংবদন্তিতে আকৃষ্ট হয়ে অনেক বণিক, পণ্ডিত , সৈনিক, শিল্পী, কারিগর ও মুসাফির রাজকীয় নগরী দিল্লিতে পৌঁছেছিল। সুলতান অনেক উপহার দিয়ে পণ্ডিতদের স্বাগত জানাতে, তাদেরকে এখানে অবস্থান করে তাদের প্রতিভার পরিচয় দিতে প্রলুব্ধ করতেন। বিপুল ভাতা নিয়ে বতুতা মালেকি মাজহাবের বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে কয়েকটি গ্রামের রাজস্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া রাজকোষ থেকেও ভাতা দেওয়া হতো, ছিল আরো নানা উপহার। অত্যন্ত মেধাবী ও উদার হওয়া সত্ত্বেও সুলতান ছিলেন খেয়ালি, সন্দেহপ্রবণ ও সহিংস। তিনি বিদেশী পণ্ডিত, বিচারক ও প্রশাসক নিয়োগ করে তার সরকারকে স্থিতিশীল করতে চাইতেন।
সুলতান সম্পর্কে ইবনে বতুতার বর্ণনাঃ
উপহার দিতে আর রক্ত ঝরাতে খুবই ভালোবাসেন সুলতান। তার দরজা থেকে কোনো গরিব মানুষই খালি হাতে ফিরত না, কিংবা জীবন্ত লোককে ফাঁসি দেওয়া হতো। তার উদারতা, সাহস এবং সেইসাথে অপরাধীদের প্রতি তার নির্দয়তা ও সহিংসতা লোকজনের মুখে মুখে ফেরে। আবার তিনি খুবই বিনয়ী, সাম্য ও ন্যায়বিচার করতে সদাপ্রস্তুত থাকেন। ইবনে বতুতা সুলতানের বিরাগভাজন হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টায় থাকতেন সবসময়। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলো না। তবে নিজের কারণে নয়, তিনি যে সুফি শেখের মুরিদ ছিলেন, সেই তিনিই সুলতানের ক্রোধে পড়েন। দরবেশকে নির্যাতন করে শিরোচ্চেদ করা হলো। টানা ৯ দিন ইবনে বতুতা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। এ সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক ভেবেছেন সুলতান। শেষ পর্যন্ত তাকে ক্ষমা করা হয়। কিন্তু তত দিনে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তিনি তার বিলাসী জীবন ত্যাগ করে পরের পাঁচ মাস কামালউদ্দিন আবদুল্লাহ আল-ঘারি নামে অপর এক সুফি সাধকের কাছে নিজেকে নিবেদন করেন। অবশেষে সুলতান তলব করেন বতুতাকে। তাকে চীনা দূতদের সফরের পর ফিরতি সফরে চীন পাঠান। সাথে দিলেন কাপড়, স্বর্ণ ও রুপার নৌকা, তরবারি, খাপ, টুপি, ঘোড়া, দাস, নর্তকি, খোজা। পাহারা দেওয়ার জন্য দেওয়া হলো হাজার সৈনিক। তবে ভাগ্য ছিল খারাপ। চীন রওনা হওয়া দলটি দিল্লির বাইরে বিদ্রোহীদের হামলার মুখে পড়ে। প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর তিনি তার গ্রুপের কাছ থেকে আলাদা হয়ে পড়েন। অনেক কষ্টের পর সপ্তাহ খানেক বাদে তিনি তার দলের সাথে মিলিত হতে পেরেছিলেন। গ্রুপটি ক্যাম্বে পৌঁছালো, সেখান থেকে কালিকট। এখানে তারা দুটি চীনা নৌকা ভাড়া করে এগিয়ে চললেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি। প্রচণ্ড ঝড় আছড়ে পড়ে তাদের নৌকায়। মূল্যবান সামগ্রী, ঘোড়া, লোকজন সবই ডুবে যায়। ইবনে বতুতার নৌকাটিও ডুবে গেল। জলদস্যূরা তাকে পাকড়াও করে। ইবনে বতুতার সাথে দিল্লির সম্পর্ক এই পর্যায়ে শেষ হয়ে গেল। দিল্লিতে ফিরে পুরো দলের বিধ্বস্ত হওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে বেঁচে যাওয়ার আশা ছিল না। বতুতার সফর অবশ্য অব্যাহত থাকে। আর তিনি চীনেও পৌঁছেছিলেন। তবে তার আগে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, সুমাত্রা ইত্যাদি স্থানে যাত্রা বিরতির পর।
দুর্দান্ত গল্প-কথকঃ
তার পুরো নাম শেখ আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আল-লাওয়াতি আল-তানজি ইবনে বতুতা। তিনি কেবল কিংবদন্তির পর্যটকই ছিলেন না, তিনি যেসব স্থান সফর করেছেন, সে সবের ইতিহাসের বিরাট উৎসও। তিনি চমৎকারভাবে তার সময়, খাবার, প্রথা, লোকজন, স্থান সম্পর্কে বর্ণনা করা কালে এমন অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, যা ওই সময়ে আর কেউ দিতে পারেননি। যারা ঘোরে, তারা হারিয়ে যান না। কথাটা এই লোকটি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রযোজ্য। তিনি তার কাহিনীর মধ্যেই বেঁচে আছেন।
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রামানুজ কলেজ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়]
ইবনে বতুতা সম্পর্কে আরো জানুনঃ-
ইসলামী সৈনিক ও চিন্তাবিদ ইবনে বতুতা
[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রামানুজ কলেজ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়]
ইবনে বতুতা সম্পর্কে আরো জানুনঃ-
ইসলামী সৈনিক ও চিন্তাবিদ ইবনে বতুতা
![]() |
সংগ্রহিত ছবি |